মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:৪৪ অপরাহ্ন

১৭ বার ফোন করেন শেখ সেলিম

অনলাইন ডেস্ক : চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন, এমন অভিযোগ আগেই উঠেছিল । বিশেষ করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে ২০২২ সালে কম জল ঘোলা হয়নি । সেবার নির্বাচনে সভাপতি পদে ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রাথমিক ভোট গণনায় জায়েদ খান জয়ী হন । কিন্তু এই ফলাফল মেনে নেননি সাধারণ সম্পাদক পদে পরাজিত প্রার্থী নিপুণ আক্তার ।

পরবর্তীকালে আদালতের নির্দেশে শিল্পী সমিতির চেয়ারে বসেন তিনি । জানা যায়, শিল্পী সমিতিতে নিপুণের দাপটের পেছনে এক রাজনীতিবিদের সরাসরি প্রভাব ছিল । সে সময় ভয়ে মুখ না খুললেও এবার প্রকাশ্যেই শিল্পী সমিতির নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনলেন সে সময় দায়িত্ব পালন করা নির্বাচন কমিশনাররা ।

সূত্র জানায়, নির্বাচনের ফলাফলের রাতটি ছিল নির্বাচন কমিশনারদের জন্য ভয়াবহ পরীক্ষার রাত । ফলাফল গণনার শুরু থেকেই একের পর এক হুমকি আসতে থাকে । পরিস্থিতি বেগতিক হয় ফলাফল ঘোষণার আগমুহূর্তে । কারণ, জায়েদ খানের চেয়ে ভোটে পিছিয়ে যান নিপুণ । তখন থেকেই একের পর এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ভয়ভীতি দেখান ।

ওই ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা পিরজাদা হারুন জানান, তিনি পাঁচবার শিল্পী সমিতির নির্বাচনে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন । তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না । কিন্তু ২০২২ সালের নির্বাচনে তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়, যা তাঁকে মানসিকভাবে এখনো আতঙ্কিত করে ।

হারুন বলেন, ‘নির্বাচনে নিপুণকে জয়ী দেখাতে অনেক ওপর থেকে এক ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ একের পর এক ফোন করতে থাকেন । তিনি সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়ে সরাসরি প্রভাব খাটাতেন, নিয়ন্ত্রণ করতেন বলা যায় । তিনি নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন । কিন্তু আমি সরাসরি “না” বলে দিই । এর আগে আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার থাকাকালীন একবার উপজেলা নির্বাচনে ওই নেতার শ্যালকের জন্য আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলেন । সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন যে আমাকে কেনা যাবে না । এ জন্য আমি বারবার সরকারি চাকরিতে পদবঞ্চিত হয়েছি ।’

পরবর্তী সময় মুঠোফোনে ভয়ও দেখানো হয়, এমনকি বড় অঙ্কের অর্থের লোভ দেখানো হয় উল্লেখ করে হারুন বলেন, ‘তখন একের পর এক ফোনে আমাকে ভয় দেখানো হয় যে তুলে নিয়ে যাবে । এখন যে আয়নাঘরের কথা শুনছি, তখন সে রকম কোনো আয়নাঘরের কথা শোনা থাকলে হয়তো সৎ থাকা সম্ভব হতো না । সেই রকম ভয় দেখানো হয়েছিল । পরে একটা জায়গায় যেতে বলেন, যেখানে বড় অঙ্কের টাকা রাখা ছিল । যখন রাজি হলাম না, তখন ফলাফল নিয়ে মামলা করা হলো । সেটা চলে গেল কোর্টে । তখন নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে । আমাকে বানিয়ে দেওয়া হলো অন্য একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য । নানা কাণ্ডে আমাকে ছোট করা হলো, এফডিসিতে নিষিদ্ধ করা হলো ।’

সে বছর ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ২০২২-২৪ মেয়াদের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে চিত্রনায়ক জায়েদ খানের কাছে ১৩ ভোটে পরাজিত হন চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার । ফলাফলে অসন্তোষ জানিয়ে ভোট পুনর্গণনার জন্য আপিল করেন নিপুণ । কিন্তু সেখানেও একই ফলাফল পায় আপিল কমিটি ।

শিল্পী সমিতির সেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যুক্ত আরেকজন জানান, এমন আতঙ্ক হবে ভাবলে তিনি দায়িত্ব পালন করতেন না । কারণ, জীবনের হুমকি ছিল । যেকোনো সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে, এমন শঙ্কা ছিল । সেগুলো ভয়ে তখন প্রকাশ করেননি । তাঁরা বিষয়গুলো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপরই ছেড়ে দেন । নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন কমিশনারদের একের পর এক ভয়ভীতি দেখিয়ে গালিগালাজ করা হয় । বলা হয় যে পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যাবে । এমন লেভেল থেকে ফোন আসবে, ভাবতেই পারিনি । আমাদের একজনকে সেই সময় নিপুণকে জয়ী করাতে ১৭ বার ফোন করেন শেখ সেলিম সাহেব, তাঁর মতো লোক । এটা আমাদের অবাক করেছিল ।’
পরে ঘটনা মামলায় গড়ায় । আদালত থেকে রায় নিয়ে শিল্পী সমিতির চেয়ারে বসে নিপুণ । তিনি পুরো সময় দায়িত্ব পালন করেন ।

দুই বছর পর ২০২৪-২৬ সালের নির্বাচন হয় গত ১৯ এপ্রিল, সেই নির্বাচনে হেরে যান নিপুণ । সভাপতি পদে জয়ী হন মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ডিপজল । সেদিন রাতেই বিজয়ীদের ফুলের মালা দেন নিপুণ । কিন্তু ২৫ দিন পরই মত পরিবর্তন করে নির্বাচিত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ পুরো কমিটির কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন নিপুণ । তবে বেশি সুবিধা করতে পারেননি ।

নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শিল্পী সমিতির প্যাড ব্যবহার করে গত জুলাই মাসে বিবৃতি দেন নিপুণ । এরপর তিনি বর্তমান কমিটির নির্বাচিত সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন, এটা তিনি সাংগঠনিক নিয়মে করতে পারেন না । তাঁর বিবৃতিতে লেখা ছিল, ‘কোটা আন্দোলনকে ইস্যু করে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করছেন এবং রাজাকারদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন, তাদের প্রতি তীব্র নিন্দা, ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি । মনে রাখতে হবে… “তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি” এই স্লোগান বাঙালি জাতির সবচেয়ে গর্বের স্লোগান । জয় বাংলা ।’ এই বিবৃতি নিয়ে শিল্পীরা নিপুণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন ।

নিপুণের সঙ্গে শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পরিচয় হলো কীভাবে? আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ সেলিম । জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বদলে যান নিপুণ । রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর চলাফেরা বাড়তে থাকে । সেই সময়ই পরিচয় ।

২০১২ সালে বনানীর অভিজাত এলাকায় নিপুণ গড়ে তোলেন নিজস্ব পারলার । সেটা উদ্বোধন করতে আসেন শেখ সেলিম । সেই থেকেই আলোচনায় আসেন নিপুণ । ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে নিপুণের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com